ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্ম এবং ফিলিস্তিনিদের উপর এর প্রভাব একটি বিতর্কিত এবং জটিল বিষয়। এই প্রবন্ধে ইসরাইলের প্রতিষ্ঠার ইতিহাস, ফিলিস্তিনিদের উপর নির্যাতনের ক্রমবিকাশ, বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য গণমাধ্যমের তথ্য ও বিশেষজ্ঞদের অভিমত, এবং মুসলিম বিশ্বের করণীয় বিষয়ে বিশদভাবে আলোচনা করা হবে।
ইসরাইলের জন্ম ইতিহাস
ইউরোপে ইহুদি নিপীড়নঃ
ইহুদি নিপীড়নের ইতিহাস বেশ পুরনো। মধ্যযুগ থেকে শুরু করে উনিশ শতক পর্যন্ত, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ইহুদিরা বৈষম্য, নির্যাতন এবং হত্যার শিকার হয়। তারা অনেক সময় সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিল। এই পরিস্থিতি থেকেই ইহুদিরা একটি নিরাপদ রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে।
জায়নিজমের উত্থান
জায়নিজম আন্দোলন শুরু হয় উনিশ শতকের শেষের দিকে। থিওডর হার্জল, একজন অস্ট্রিয়ান সাংবাদিক, ১৮৯৬ সালে "দ্য জিউশ স্টেট" বইটি লেখেন, যেখানে তিনি একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন। ১৮৯৭ সালে প্রথম জায়নিজ কংগ্রেস সুইজারল্যান্ডের বাসেলে অনুষ্ঠিত হয়। এখানে ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
ব্যালফোর ঘোষণা
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়, ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ সরকার ব্যালফোর ঘোষণা প্রকাশ করে, যেখানে ব্রিটিশ সরকার ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি জাতীয় গৃহ প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেয়। এই ঘোষণার ফলে ফিলিস্তিনে ইহুদি অভিবাসনের প্রবাহ বাড়ে।
হলোকাস্ট এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হলোকাস্টের মাধ্যমে ছয় মিলিয়ন ইহুদি নিহত হয়। এই নারকীয় ঘটনার পর ইহুদিরা আরও তীব্রভাবে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। হলোকাস্ট ইহুদিদের মধ্যে তাদের জাতীয় সত্তার প্রতি একটি গভীর সংকল্প তৈরি করে, যা ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পথে একটি বড় চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে।
জাতিসংঘ প্রস্তাব এবং ইসরাইলের স্বাধীনতা
১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে দুটি পৃথক রাষ্ট্রে বিভক্ত করার প্রস্তাব পাশ করে। একটি ইহুদি রাষ্ট্র এবং একটি আরব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দেওয়া হয়। ইহুদিরা এই প্রস্তাব মেনে নিলেও আরবরা তা প্রত্যাখ্যান করে। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ইসরাইল স্বাধীনতা ঘোষণা করে। এর পরপরই আরব দেশগুলো ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এই যুদ্ধের ফলে ইসরাইল তার সীমানা বৃদ্ধি করে এবং লক্ষাধিক ফিলিস্তিনি তাদের বাসস্থান থেকে বিতাড়িত হয়।
ফিলিস্তিনিদের উপর নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ
ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পর থেকে ফিলিস্তিনিরা ক্রমাগত নির্যাতনের শিকার হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনা ও পরিস্থিতি আলোচনা করা হলো।
নাকবা বা মহা বিপর্যয়
১৯৪৮ সালের যুদ্ধের সময় প্রায় ৭ লাখ ফিলিস্তিনি তাদের ঘরবাড়ি হারায় এবং শরণার্থী হয়ে পড়ে। এই ঘটনা "নাকবা" নামে পরিচিত। ফিলিস্তিনিদের দাবি, ইসরাইল তাদের জোরপূর্বক বিতাড়িত করেছে, যা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন।
১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধ এবং পশ্চিম তীর ও গাজা দখল
১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধে ইসরাইল পশ্চিম তীর, গাজা, পূর্ব জেরুজালেম এবং গোলান মালভূমি দখল করে। এই অঞ্চলগুলোতে ফিলিস্তিনিদের উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয় এবং অনেক ফিলিস্তিনি তাদের বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ হয়।
ইন্তিফাদা এবং ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ
১৯৮৭ এবং ২০০০ সালে দুটি ইন্তিফাদা (প্রতিরোধ আন্দোলন) শুরু হয়। প্রথম ইন্তিফাদা ছিল ফিলিস্তিনিদের অসহযোগ আন্দোলন, যেখানে তারা ইসরাইলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। দ্বিতীয় ইন্তিফাদা ছিল আরও সহিংস, যেখানে ফিলিস্তিনিরা সশস্ত্র প্রতিরোধ শুরু করে।
গাজার অবরোধ এবং সামরিক অভিযান
২০০৭ সাল থেকে ইসরাইল গাজার উপর কঠোর অবরোধ আরোপ করে রেখেছে, যা মানবিক সংকট তৈরি করেছে। এছাড়া ইসরাইল গাজার উপর একাধিক সামরিক অভিযান পরিচালনা করেছে, যার ফলে বহু ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছে। ২০১৪ সালের যুদ্ধের সময়, প্রায় ২২০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়, যাদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল সাধারণ নাগরিক।
বিশ্বস্ত গণমাধ্যমের তথ্য ও বিশেষজ্ঞদের অভিমত
বিভিন্ন বিশ্বস্ত গণমাধ্যম এবং বিশেষজ্ঞরা ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাতের বিষয়ে তাদের অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ এনেছে। তাদের মতে, ইসরাইল ফিলিস্তিনিদের উপর অত্যাচার এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে।
আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন
জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ইসরাইলের দখলদারিত্বকে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচনা করে। তারা বলেছে, ইসরাইলের স্থায়ী বসতি স্থাপন এবং ফিলিস্তিনিদের উপর হামলা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন এবং জেনেভা কনভেনশনের লঙ্ঘন।
মুসলিম বিশ্বের করণীয়
মুসলিম বিশ্ব ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংকটের সমাধানে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এখানে কিছু প্রস্তাব উল্লেখ করা হলো।
ঐক্যবদ্ধ অবস্থান
মুসলিম দেশগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ফিলিস্তিনিদের অধিকার আদায়ের জন্য আন্তর্জাতিক মহলে শক্তিশালী কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
অর্থনৈতিক ও মানবিক সহায়তা
ফিলিস্তিনিদের মানবিক সহায়তা প্রদান এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়তা করা প্রয়োজন। এতে করে তারা তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করতে পারবে।
শান্তি আলোচনা
মুসলিম দেশগুলোকে ইসরাইল এবং ফিলিস্তিনের মধ্যে শান্তি আলোচনা পুনরায় শুরু করতে উৎসাহিত করতে হবে।
আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি
ইসরাইলের উপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করতে হবে যাতে তারা মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ করে এবং ফিলিস্তিনিদের স্বার্থ রক্ষা করে।
শিক্ষা এবং সচেতনতা বৃদ্ধি
মুসলিম বিশ্বকে ফিলিস্তিন সংকট সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। এ জন্য শিক্ষাব্যবস্থায় ফিলিস্তিন ইস্যু অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। শিক্ষার্থীরা যাতে ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংকট সম্পর্কে সচেতন হয় এবং এ বিষয়ে তাদের জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি পায়, তা নিশ্চিত করতে হবে।
অর্থনৈতিক বর্জন
মুসলিম দেশগুলোকে ইসরাইলি পণ্য এবং প্রতিষ্ঠানগুলোকে বর্জনের আহ্বান জানানো যেতে পারে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক চাপ ইসরাইলের নীতিমালায় প্রভাব ফেলতে পারে।
সংস্কৃতির মাধ্যমে প্রতিরোধ
সংস্কৃতি, শিল্প ও সাহিত্য মাধ্যমে ফিলিস্তিনের সংগ্রামের গল্প প্রচার করতে হবে। মুসলিম বিশ্বের লেখক, শিল্পী এবং চলচ্চিত্র নির্মাতাদের ফিলিস্তিন ইস্যুতে কাজ করা এবং তাদের কাজের মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে সচেতন করা উচিত।
উপসংহার
ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাত একটি জটিল এবং দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা। ইসরাইলের প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত ফিলিস্তিনিরা নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞের শিকার হচ্ছে। এই সংকটের সমাধানে মুসলিম বিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা, অর্থনৈতিক ও মানবিক সহায়তা এবং শান্তি আলোচনার মাধ্যমে এই সংকটের একটি স্থায়ী সমাধান সম্ভব। মুসলিম বিশ্বের ঐক্যবদ্ধ ও কার্যকর পদক্ষেপ ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাতের একটি ন্যায্য ও স্থায়ী সমাধান আনতে সহায়ক হতে পারে।

0 মন্তব্যসমূহ